ভারতীয় সংবিধানের পটভূমি
ভারতীয় সংবিধানের পটভূমি |
ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হয় ২৬ জানুয়ারী ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে। ব্রিটিশ আইনগুলিকে ভারতীয় সংবিধানের পটভূমি হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
ব্রিটিশ আইনগুলির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা :
১. চার্টার অ্যাক্ট/সনদ আইন (১৮১৩ খ্রিঃ):
- ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকৃত অঞ্চলের ওপর ব্রিটিশ সরকারের সার্বভৌম অধিকার ঘােষণা করা হয়।
- ভারতবর্ষে একচেটিয়া ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের অবসান ঘটে।
- কোম্পানির চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে উপযুক্ত শিক্ষাগত যােগ্যতার কথা ঘােষণা করা হয়।
২. চার্টার অ্যাক্ট / সনদ আইন (১৮৩৩ খ্রিঃ):
- প্রশাসনিক দপ্তরকে আইন দপ্তর থেকে আলাদা করা হয়।
- কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
- ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় সাম্রাজ্যে একই ধরনের আইন বলবৎ করার কথা বলা হয়।
- ভারতীয় সিভিল সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করা হয়।
৩. চার্টার অ্যাক্ট / সনদ আইন (১৮৫৩ খ্রিঃ) :
- কেবলমাত্র বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি শাসনের জন্য একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিযুক্ত করা হয়।
৪. ভারত শাসন আইন (১৮৫৮ খ্রিঃ):
- ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটানাে হয়।
- ভারতের শাসনভার সরাসরি ব্রিটিশ রাজতন্ত্র তথা মহারানী ভিক্টোরিয়ার হাতে ন্যাস্ত হয়।
- এই আইন অনুযায়ী ভারতের গভর্নর জেনারেলকে ভাইসরয়’ পদে উন্নীত করা হয়।
- স্থল বাহিনী ও নৌ বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব ব্রিটেনের রাজা বা রানীর ওপর ন্যস্ত হয়।
- ভারতে শাসনের জন্য একজন ভারত সচীব (Secretary of State for India) নিযুক্ত করা হয়।
৫. ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট / পরিষদ আইন ১৮৬১ :
- বিভিন্ন প্রদেশে আইন পরিষদ (বিধান পরিষদ) প্রতিষ্ঠা হয়।
- কলকাতা, বােম্বাই ও মাদ্রাজে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ভাইসরয়ের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ (Imperial legislative council) এর সদস্য সংখ্যা ৬ থেকে বাড়িয়ে ১২ করা হয়।
৬. ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট / পরিষদ আইন ১৮৯২ :
- প্রাদেশিক আইনসভার হাতে শুধুমাত্র বাজেট আলােচনার অধিকার দেওয়া হয়।
৭. ইন্ডিয়াল কাউন্সিল অ্যাক্ট / পরিষদ আইন ১৯০৯ / মার্লে -মিন্টো সংস্কার :
- কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য সংখ্যা বাড়ানাে হয় এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘােষিত হয়
- মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের কথা ঘােষণা করা হয়।
- মার্লে ছিলেন ভারত সচীব এবং লর্ডমিন্টো ছিলেন ভাইসরয়।
৮. ভারত শাসন আইন ১৯১৯ / মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার:
- কেন্দ্রীয় আইনসভা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট করা হয়।
- প্রাদেশিক সরকারের অধীনে অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলার দায়িত্ব, স্বাস্থ্য, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন, বিচার, জেল প্রভৃতি বিষয় রাখা হয়।
- মন্টেগু ছিলেন ভারতসচীৰ এবং চেমসফোর্ড ছিলেন ‘ভাইসরয়'।
৯. ভারত শাসন আইন ১৯৩৫ :
- প্রাদেশিক আইন সভাকে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট করা হয় মূলত ছয়টি প্রদেশে। যথা— বাংলা, বােম্বাই, মাদ্রাজ, আসাম ও উত্তরপ্রদেশ ।
- ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে তােলার কথা বলা হয়।
- বিকেন্দ্রীকরণের দ্বারা এদেশে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। ক্ষমতাকে তিনটি ভাগে | বিভক্ত করা হয়েছিল যথা, কেন্দ্রীয় তালিকা, প্রাদেশিক তালিকা ও যুগ্ম তালিকা।
- এই আইনে ৩২১টি অধ্যায় এবং ১০টি তালিকা (Schedule) ছিল।
- শিখ, ইউরােপীয় ও অ্যাংলাে ইন্ডিয়ানদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের ব্যবস্থা হয়। ১৯৩৫ এর ভারত শাসন অনুযায়ী ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস মন্ত্রীসভা প্রদেশগুলিতে কাজ শুরু করে।
১০. ক্রিপস প্রস্তাব :
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ভারতের সহযােগিতা পাওয়ার আশায় উপ-প্রধানমন্ত্রী স্টাফোর্ড ক্রিপসকে (১৯৪২ খ্রিঃ) ভারতে পাঠান।
- ক্রিপস এর প্রস্তাবগুলি হল। যথা— যুদ্ধের অবসানে ভারতীয়দের ডােমিনিয়নের মর্যাদা, ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধানসভা গঠন, ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব কিন্তু আপাতত ব্রিটিশদের হাতে থাকবে প্রভৃতি।
১১. ওয়াভেল প্রস্তাব :
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের প্রস্তাবগুলি হয়। যথা- অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য আহ্বান ভারতীয়দের, ভারতের সংবিধান প্রণয়ন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ শুরু করা, ভাইসরয়ের শাসন পরিষদে ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত প্রভৃতি।
১২. ক্যাবিনেট মিশন:
- দেশব্যাপী অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি ভারতে মন্ত্রী মিশন (ক্যাবিনেট মিশন) পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিলেন।
- ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ক্যাবিনেট মিশন (তিনজন মন্ত্রীসভার সদস্য) ভারত আসেন।
- মিশনের সপারিশ অনুযায়ী ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে।
- সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ গঠিত হবে।
- এই গণপরিষদের মােট সদস্য সংখ্যা হবে ৩৮৯ জন।
১৩. মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনা :
- ১৯৪৭ খ্রিঃ ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি ঘােষণা করলেন যে, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের মধ্যে ইংরেজ ভারত ত্যাগ করবে।
- এই সময়ের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের সমস্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে হবে। এই সময় ভারতে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।
- এইরূপ অবস্থায় ১৯৪৭ খ্রিঃ মার্চ মাসে ভাইসরয় হিসাবে দায়িত্ব নেন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন।
- ১৯৪৭ খ্রিঃ ৩ জুন ভারত বিভাগ সংক্রান্ত যে পরিকল্পনা উপস্থাপিত করেন, যা 'মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত।
- ভারত বিভাগ ও মুসলিম প্রধান অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির সিদ্ধান্ত হয়। বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশ দুটি বিভক্ত হবে।
- উভয় রাষ্ট্রই ব্রিটিশ কমনওয়েলথ পরিত্যাগ করতে পারে।
- ভারতে ও পাকিস্তানে যােগদানে অনিচ্ছুক অঞ্চল সমূহের অধিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান।।
১৪. ভারতীয় স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭ :
- মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে "ভারতের স্বাধীনতা আইন" পাশ হয়।
- ১৮ জুলাই ১৯৪৭ রাজকীয় সম্মতি লাভ করে।
- এই আইনের ভিত্তিতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে অপরদিকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে।
- বিভক্ত বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমানা স্থির করার জন্য র্যাডক্লিফকে দায়িত্ব দেওয়া হল।
- নতুন সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত উভয় রাষ্ট্রই ১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইন অনুযায়ী শাসন করবে।
- স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের গভর্নর জেনারেল পদে বসেন মহম্মদ আলি জিন্না এবং প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলি খান।
- দুটি রাষ্ট্রের গণপরিষদ বা সংবিধান সভার ওপর নতুন সংবিধান রচনার ভার অর্পিত হয়।
গণ পরিষদ :
- মােট ২৯৬ জন সদস্য নির্বাচিত হন।
- এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন জওহরলাল নেহরু, বি.আর. আম্বেদকর, বল্লভভাই প্যাটেল, আবুলকালাম আজাদ, সি. রাজা গােপালাচারী, আল্লাদী কৃয়স্বামী প্রমুখ।
- দ্বিতীয় অধিবেশন বসে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি।
- তৃতীয় অধিবেশন বসে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ এপ্রিল।
- তৃতীয় অধিবেশনে কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্র কমিটির সভাপতি হন জওহরলাল নেহরু এবং প্রাদেশিক শাসনযন্ত্র কমিটির সভাপতি হন বল্লভভাই প্যাটেল।
- স্বাধীনতা লাভের পর এই গণপরিষদ বিভক্ত হয়ে 'ভারতীয় গণপরিষদ’ ও ‘পাকিস্তান গণ পরিষদ’ নামে দুটি স্বতন্ত্র সংস্থার জন্ম হয়।
- স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের গণপরিষদে সংবিধান খসড়া কমিটির সভাপতি হন বি.আর.আম্বেদকর (মন্ত্রীসভার সদস্য) গণ পরিষদের স্থায়ী সভাপতি হন ড: রাজেন্দ্রপ্রসাদ।
- ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি সংবিধান কার্যকর হয়।
- এই সংবিধান অনুসারে ভারতবর্ষে প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কার্যকরী হয়।
- এই কারণে ২৬ জানুয়ারি দিনটি ভারতে প্রজাতন্ত্র দিবস (Republic Day) বা সাধারণ তন্ত্র দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়।
- এই সংবিধান অনুসারে প্রজাতান্ত্রিক ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ এবং প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি হন রাধাকৃষ্ণন ।