ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো ব্যবস্থা
আন্তঃরাজ্য পরিষদ
১. কেন্দ্র-রাজ্য এবং বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে পারস্পরিক সহযােগিতাকে সুনিশ্চিত করার জন্য আন্তঃরাজ্য পরিষদ গঠন করা হয়েছে। সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি এই পরিষদ গঠন করেন। এই পরিষদের কার্যাবলী ও দায়িত্ব নির্ধারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যাস্ত আছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন আন্তঃরাজ্য পরিষদের পদাধিকার বলে সভাপতি।
২. আন্তঃরাজ্য পরিষদের কাজগুলি হল —
ক) রাজ্যগুলির মধ্যে বিরােধের কারণ খোঁজা ও সমাধানের পরামর্শ দেওয়া।
খ) কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির সাধারণ স্বার্থসম্পর্কিত বিষয় বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান করা।
গ) আন্তঃরাজ্য সংহতি সাধনের স্বার্থে পন্থা পদ্ধতি সুপারিশ করা প্রভৃতি।
৩. যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার একটি অঙ্গ হিসাবে ভারতে আন্তঃরাজ্য পরিষদ (Inter State Council) গঠন করা হয়েছে।
আঞ্চলিক পরিষদ
১. কেন্দ্র ও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে সমগ্র ভারতকে ৬টি আঞ্চলিক পরিষদে (বিভাগে) বিভক্ত করা হয়েছে।
২. আঞ্চলিক পরিষদের কোন উল্লেখ ভারতীয় সংবিধানে নেই। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের রাজ্য পুনগঠন আইনের মাধ্যমে আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়। কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন পদাধিকার বলে প্রতিটি (৬টি) আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান।
৩. আঞ্চলিক পরিষদের মূল দুটি কাজ হল— ক) এহ পরিষদের মধ্য দিয়ে কেন্দ্র রাজ্যের মধ্যে পারস্পরিক সহযােগিতা ও নির্ভরশীলতা গড়ে তুলতে পারে। এবং খ) আঞ্চলিক পরিষদের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সাধারণ কার্য সম্পাদিত কোনাে বিষয়ে সমস্যার সৃষ্টি হলে এই পরিষদ সে ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করে।
কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে আইন বিষয়ক সম্পর্ক :
সংবিধানের ২৪৫-২৫৫ নং ধারায় কেন্দ্র ও রাজ্যের আইন বিষয়ক সম্পর্কটি আলােচিত হয়েছে। রাজ্য সরকার তার আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা নিজের ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। অপরদিকে কেন্দ্রের ক্ষেত্রে এই আইন বিষয়ক ক্ষমতা অনেক বেশি। রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সহ সমস্ত ভারতই সংসদের আইন প্রণয়নমূলক ক্ষমতার অন্তর্গত। সংসদের হাতে দেশ বহির্ভূত অঞলের জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আছে। কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণে আইন সংক্রান্ত ক্ষমতার বন্টনকে ভারতীয় সংবিধানে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- ১) কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত আইন, ২) রাজ্য তালিকাভুক্ত আইন, ৩) যুগ্ম-তালিকা ভুক্ত আইন এবং ৪) অবশিষ্ট ক্ষমতাসমূহ।
কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত আইন :
কেন্দ্রীয় তালিকায় জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত বিষয়সমূহ রয়েছে। কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত সমস্ত বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা এককভাবে পার্লামেন্টের হাতে। কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত ৯৯টি (মূল সংবিধানে ৯৭টি ছিল) বিষয়ের মধ্যে আছে : জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী, পররাষ্ট্রনীতি, ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা, মুদ্রা, রেল, বিমান, বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক ঋণ, কুটনৈতিক প্রতিনিধি, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন, আদমশুমারি, নির্বাচন কমিশন, সংসদ, রাজ্য আইনসভা, রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচন সংক্রান্ত, রাজ্য ও কেন্দ্রের হিসাব-নিকাশ পরীক্ষা, যুদ্ধ ও শান্তি, ডাকবিভাগ, আণবিক শক্তি, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সন্ধি প্রভৃতি।
রাজ্য তালিকাভুক্ত আইন :
রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা একক ক্ষমতা ভােগ করে। তবে দেশে জরুরী অবস্থা ঘােষিত হবার পর পার্লামেন্ট রাজ্য তালিকাভুক্ত যে কোন বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে। রাজ্য তালিকাভুক্ত ৬১টি (মূল সংবিধানে ছিল ৬৬টি) বিষয়ের মধ্যে আছে রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা, পুলিশ, জেলা প্রশাসন, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন, জনস্বাস্থ্য, হাসপাতাল, গ্রন্থাগার, মৎসচাষ, রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য, রাজ্যের রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন, প্রতিবন্ধী ও বেকারদের ত্রাণ, রাজ্যের সরকারি ঋণ, ভূমি রাজস্ব প্রভৃতি।
যুগ্ম তালিকাভুক্ত আইন :
যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়গুলির মধ্যে কেন্দ্রীয় আইনসভা (পার্লামেন্ট) ও রাজ্য আইনসভাগুলির উভয়ই আইন প্রণয়ন করার অধিকারী, তবে সংবিধানে বলা হয়েছে যুগ্ম বিরােধ দেখা দিলে কেন্দ্রীয় সরকারের আইনই বলবৎ থাকবে। যুগ্ম তালিকাভুক্ত ৫২টি (মূল সংবিধানে ৪৭টি ছিল) বিষয়ের মধ্যে আছে : শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনা, ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিধি, নিবর্তনমূলক আটক আইন, অরণ্য, পশুপক্ষী সংরক্ষণ, সামাজিক বিমা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা, আদালত অবমাননা, ট্রেড ইউনিয়ন, শিল্প ও শ্রমবিরােধ, বিদ্যৎ, বিবাহ, শ্রমিক, কল্যাণ প্রভৃতি।
অবশিষ্ট ক্ষমতা সমূহ :
উপরিউক্ত তিনটি তালিকা (কেন্দ্রীয়, রাজ্য ও যুগ্মাতালিকা) ব্যতিরেকে ভারতীয় সংবিধানের ২৪৮ নং ধারানুযায়ী অবশিষ্ট ক্ষমতাসমূহ কেন্দ্রীয় আইনসভা (পার্লামেন্ট)-র হাতে ন্যাস্ত রয়েছে। কানাডা সংবিধানকে অনুসরণ করেই অবশিষ্ট ক্ষমতাগুলি রাজ্যের পরিবর্তে কেন্দ্রের হাতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার সংবিধানে অবশিষ্ট ক্ষমতা কেন্দ্রের পরিবর্তে রাজ্যগুলির হাতে অর্পণ করেছে।
কেন্দ্র ও রাজ্যের আর্থিক সম্পর্ক :
কেন্দ্রীয় তালিকার অন্তর্ভুক্ত ১৩টি রাজস্ব-বিষয়ক ক্ষমতার মধ্যে আছে- আয়কর (কৃষি আয় বাদে), ব্যয় কর, উত্তরাধিকার কর, আমদানি ও রপ্তানি কর, কোম্পানির আয়ের ওপর ধার্য কর ইত্যাদি। এর মধ্যে বাণিজ্য কর, কোম্পানির আয়ের ওপর কর, ব্যক্তি ও কোম্পানির সম্পদের মূলধন মূল্যের ওপর কর, আয়করের ওপর অতিরিক্ত কর প্রভৃতি থেকে সংগৃহীত অর্থ কেন্দ্র একাই ভােগ করে।
রাজ্য তালিকায় ১৯টি বিষয়ে রাজ্য আইনসভা কর ধার্য এবং সংগ্রহের ক্ষমতা পেয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল— ভূমিরাজস্ব (কৃষি আয়) মদ-আফিম-গাজা সহ অন্যান্য মাদক দ্রব্য, সাধারণ বিক্রয় কর, বিদ্যুৎ কর, কৃষিজমির উত্তরাধিকারের ওপর কর, পশু এবং নৌকোর ওপর কর, কৃষিজাত আয়ের ওপর কর প্রভৃতি।
কেন্দ্রীয় তালিকায় এমন কিছু কর বা শুল্ক আছে যা কেন্দ্র ধার্য করে কিন্তু রাজ্য তা সংগ্রহ করে ও ভােগ করে। কেন্দ্র শাসিত অণ্ডলের ক্ষেত্রে অবশ্য কেন্দ্রই রাজস্ব সংগ্রহ করে। যেমন- স্ট্যাম্প কর এবং ওষুধপত্র ও প্রসাধন সামগ্রীর উপর ধার্য অন্তঃশুল্ক।
কেন্দ্রীয় সরকার কয়েকটি কর ধার্য এবং সংগ্রহ করে কিন্তু কর থেকে সংগৃহীত অর্থ রাজ্যসমূহের মধ্যে বন্টন করা হয়। যেমন— কৃষিজমি বাদে অন্য সম্পত্তির ওপর কর ও উত্তরাধিকার কর, রেল, জলপথ এবং বিমান বাহিত যাত্রী এবং পণ্যের ওপর কর প্রভৃতি।
কেন্দ্রীয় তালিকায় এমন কিছু কর বা শুল্ক আছে যা কেন্দ্রীয় সরকার ধার্য ও সংগ্রহ করে। কিন্তু সংগৃহীত অর্থ কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বন্টিত হয়। যেমন- আয়কর, ও কেন্দ্রীয় উৎপাদন কর প্রভৃতি। সংবিধানে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর রাজ্য সরকারগুলিকে প্রয়ােজনে অনুদান দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রশাসনিক সম্পর্ক :
সংবিধানের সপ্তম তফশিলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে (আইন, অর্থ ও প্রশাসনিক) ক্ষমতা বন্টিত হয়েছে। প্রশাসনিক ক্ষমতাটিকে নিয়ে উভয় সরকারের মধ্যে প্রায় দ্বন্দ্ব লেগে যায়। সংবিধানের ২৫৬ নং ধারানুযায়ী রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষমতা এমনভাবে প্রয়ােগ করার কথা বলা হয়েছে তা যেন সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
সংবিধানের ২৫৭ নং ধারানুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলিকে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দান করতে পারে। দুটি উল্লেখযােগ্য নির্দেশ দান হল-
ক) সেনাবাহিনী বা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সাথে জড়িত যােগাযােগ ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেন্দ্র রাজ্যকে নির্দেশ দিতে পারে।
খ) রেলওয়ে ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাজ্য সরকারগুলিকে কেন্দ্র নির্দেশ দিতে পারে। তবে অর্থ খরচ কেন্দ্র বহন করবে।
৩৫৩ নং ধারানুযায়ী জরুরী অবস্থা ঘােষিত হওয়ার পর কেন্দ্র রাজ্যকে প্রশাসনিক বিষয়ে নির্দেশ দিতে পারে। ৩৫৬ নং ধারা জারী হলে রাষ্ট্রপতি সেই রাজ্যের সকল প্রশাসনিক ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন। আর্থিক জরুরী অবস্থাকালে কেন্দ্র রাজ্যগুলিকে নির্দেশ দান করতে পারে।
রাজ্যপাল তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রযােগ করে রাজ্য আইনসভা প্রণীত যে কোন বিলে তার সম্মতি না দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দিতে পারে। ২৫২ নং ধারানুযায়ী কেন্দ্র যে সমস্ত প্রশাসনিক ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ দেয় যেগুলি রাজ্য সরকার সাধারণ অবস্থাতেও মানতে বাধ্য। জাতীয় সংহতি, ঐক্য, নিরাপত্তা সর্বোপরি সার্বভৌমিকতা রক্ষার স্বার্থে রাজ্য সরকারের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকারকেই অধিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।