ভারতীয় অর্থনীতির ইতিহাস
|
ভারতীয় অর্থনীতির ইতিহাস - History of Indian Economy |
ভারতীয় রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক কাঠামাে বহুকাল পর্ব থেকেই যথেষ্ট বৈচিত্র্যময়। এর কারণ হিসাবে যেমন ভারতবর্ষের বিশাল মানচিত্রের আকৃতিও প্রতীয়মান, ঠিক তেমনি ভারতের বিপল সঞ্জিত সম্পদের আকর্ষণে বিভিন্ন সময়ে বাহরাগত জাতিদের প্রবেশ এবং দখলদারী রাজত্বও সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত।
আর সেই সুত্র ধরেই শাসনকার্যের সুবিধার্থে রাজনৈতিক প্রসারের উদ্দেশ্যেহ বিভিন্নভাবে বিভিন্নরকম অর্থনৈতিক কাঠামাে পরিলক্ষিত হয়। বিনিময় প্রথা পরিবর্তিত হয়ে কড়ি, মােহর এবং ধীরে ধীরে তা পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক অর্থব্যবস্থা (Modern financial system)-তে রপান্তরিত হয়েছে বিশ্ব বাণিজ্যের সাথে সাম্যবস্থা বজায় রেখে অবশ্যই।
প্রাক ব্রিটিশ রাজত্বে আমরা মূলত বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে স্বর্ণমুদ্রা (মােহর), রৌপ্য বিনিময় অথবা কোনাে কোনাে অঞ্চলে প্রাচীন বিনিময় প্রথাও দেখতে পাবাে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনকালীন সময়ে ভারতীয় অর্থনীতিতে পাশ্চাত্য আধুনিক অর্থব্যবস্থার বিভিন্ন রূপ প্রযুক্ত হতে থাকে এবং ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লব (১৮৪২) র ছোঁয়ায় ভারতীয় অর্থনীতি ক্রমাগত বিবর্তিত হতে থাকে ঔপনিবেশিকতার (colonialism) আড়ালে। তবে এই বিবর্তন সবক্ষেত্রে ভারতীয় আভ্যন্তরীণ সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছে, বলা ভুল- বিভিন্নভাবে ভারতীয় অর্থনীতি ও সম্পদ ক্ষয়ীভূত হয়েছে অসম বিনিময় (unequal exchange) এবং আভ্যন্তরীন শােষন-এর কারণে।
ব্রিটিশ রাজত্বে ভারতীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কিছু বিবর্তন নিম্নে উল্লেখ করা হল
(ক) ভূমিরাজস্ব নীতি :
ভারতের বৃহৎ আকৃতি এবং বিভিন্ন জাতির সহাবস্থানের কারণে সব জায়গাতে একই ভূমিরাজস্ব নীতি প্রয়ােগ করা ইংরেজদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন অঞলে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তাই বিশেষ কিছু অঞলের জন্য বিশেষ নীতি প্রযুক্ত হয়েছিল।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (Permanent Settlement) :
১৭৯৩ সালে কর্ণওয়ালিশ মূলত বঙ্গদেশ (অধুনা বিহার, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) অঞলে এটি প্রয়ােগ করেন। এর মাধ্যমেই জমিদারী প্রথা-র উন্মেষ ঘটেছিল এবং জমিদাররেরা সংশ্লিষ্ট অঞলের ভূমিরাজস্ব আদায় করতেন, এই শর্তে যদি ভবিষ্যতে উৎপাদন বাড়ে সেক্ষেত্রে জমিদার বেশী রাজস্ব দাবি করতে পারবেন না এবং এর বিনিময়ে বিভিন্ন সময়ে সরকারি সহায়তা যেমন ‘যৌতুক ও ভেট’ লাভ করবেন। এই প্রথায় বংশপরম্পরায় ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে থাকত।
মহলওয়ারি ব্যবস্থা :
১৮৩৩ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক দ্বারা প্রযুক্ত হয় সর্বপ্রথম আগ্রা ও আওয়াধ এবং ধীরে ধীরে সমগ্র পাঞ্জাবে ব্যপ্ত হয়। 'মহল’ কথাটির অর্থ গ্রাম, অর্থাৎ এই ব্যবস্থায় প্রতিটি গ্রামকে এক 'একটি একক’ (unit) ধরা হত এবং সম্মিলিতভাবে একটি গ্রাম কমিটির মাধ্যমে রাজস্ব জমা হত।
রাওয়াতওয়ারী ব্যবস্থা :
১৮২০ সালে থমাস মনরাে এই ব্যবস্থাটি প্রয়ােগ করেছিলেন দক্ষিণ মাদ্রাজ, বােম্বাই, পূর্ব পাঞ্জাব এবং আসামের কিছু অংশে। এক্ষেত্রে জমিদারী বন্দোবস্ত সাময়িকভাবে প্রযুক্ত হয়েছিল। তবে ১৮৪০ সালের মধ্যেই এই ব্যবস্থা অবলুপ্ত হয়েছিল কারণ নিযুক্ত রাওয়াত’ এরা উদ্বৃত্ত মুনাফার বেশী অংশ দাবী করেছিল যা ব্রিটিশ নীতির পরিপন্থি ছিল।
(খ) সেচ ব্যবস্থা :
কিছু ভারতীয় অর্থনীতিবিদ (জাতীয়তাবাদী), যেমন— বিধানচন্দ্র, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখের মতানুসারে কৃষিব্যবস্থা সম্পর্কে ব্রিটিশদের অপ্রতুল জ্ঞান ভারতীয় কৃষির উন্নয়নের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যদিও লর্ড ডালহৌসির সময়কালে, ১৮৫৫ সালে 'পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতীয় সেচ ব্যবস্থার সাময়িক উন্নয়ন ঘটানাে হয়েছিল।
• ১৮২১ সালে 'পশ্চিম যমুনা খাল’ এবং ১৮৩০ সালে পূর্ব যমুনা খাল সংস্কারের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রথম সেচকার্য ভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। এছাড়াও ১৮৫৪ সালে কোম্পানী কর্তৃক ‘গঙ্গাখাল’ উন্মুক্তকরণ ও সংস্কার প্রকল্প গৃহীত হয়েছিল, হিসাব অনুযায়ী যার মূলধনী খরচ ছিল প্রায় ৩ মিলিয়ন ডলার।
•পরবর্তীকালে আন্তঃরাজ্য সেচব্যবস্থার উন্নতি ঘটানাের জন্য সুক্কুর (Sukkur) ব্যারেজ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, যাকে বলা হয় কোম্পানী কর্তৃক গৃহীত সর্বাপেক্ষা বৃহৎ সেচ প্রকল্প।
• তবে, সেচ ব্যাবস্থার উন্নয়ন সমগ্র ভারতব্যাপী ঘটাতে কোম্পানি অক্ষম ছিল। মূলত , সিন্ধু, মাদ্রাজ প্রভৃতি প্রদেশকে (১৯১৪ - ১ ৯৩৯ সালের মধ্যে) প্রায় ৯০ শতাংশ সেচকার্যের আওতায় আনা হয়েছিল।
(গ) রেলব্যবস্থা :
কোম্পানী কর্তৃক ভারতবর্ষে রেল ব্যবস্থার সূচনাকে এক যুগান্তকারী পাদ্দক্ষেপ” বলেই মনে করেন অর্থনিতীবিদগণ। জাতীয়তাবাদী অর্থনীতিবিদ (Nationalist Economists)-দের সাথে চিরকালীন রেল ব্যবস্থা বনাম সেচব্যবস্থা বির্তক পাশাপাশি বিদ্যামান।ভারতে রেলব্যাবস্থা আগমনের কারণ হিসাবে ব্রিটিশ রাজ্ খরা প্রবণতা এবং খাদ্য সংকট এর মোকাবিলার হাতিয়ার হিসাবে খাড়া করেছিল ।
• ১৮৪৪ সাল থেকে চিন্তাভাবনা চলতে থাকলেও ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল ভারতবর্ষে প্রথম রেল চলেছিল বােম্বাই থেকে থানে অবধি প্রায় ২১ মাইল (৩৩.৮১) পথ অতিক্রম করে।
• সুলতান, সাহেব ও সিদ্ধ প্রথম তিনটি স্টিম ইঞ্জিন যাত্রী পরিবহন করেছিল ভারতবর্ষে। ১৮৭৩ সালে প্রথম ডিজেল চালিত ইঞ্জিন চালু হয়েছিল।
মূলত দুটি বেসরকারী কোম্পানী :
ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে (E.I.R) এবং গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে কোম্পানী (G.I.P.R) (১৮৪৪ সাল)-র তত্ত্বাবধানে রেলব্যবস্থা পরিচালিত হত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘পরাতন’ গ্যারেন্টি সিস্টেম (Old guarantee system) র আওতাধীনে।
(ঘ) মুদ্রাব্যবস্থা :
ব্রিটিশ রাজত্বকালে পূর্বাবস্থান ভারতবর্ষে কোন নির্দিষ্ট বিনিময় মাধ্যম হিসাবে নির্দিষ্ট কোন মুদ্রা ব্যবস্থা চালু ছিলনা। ব্রিটিশ রাজত্বকালীন বিভিন্ন সময়ে প্রয়ােজন অনুসারে বিনিময়ের মাধ্যম বিবর্তিত হয়েছে। এগুলিকে আমরা মূলত তিন পর্যায়ে ভাগ করতে পারি—
১। রৌপ্য বিনিময় (Silver standard, 1835-93)
২। মধ্যবর্তী পর্যায় (Intermediary stage, 1893-98)
৩। স্বর্ণ বিনিময় (Gold standard, 1898-1923)
প্রথম পর্যায়ের ক্ষেত্রে ১৮৭৩ সালের পর আমেরিকান গৃহযুদ্ধের (Civil war) প্রভাবে ভারতীয় উৎপন্ন দ্রব্যের চাহিদা বাড়ায় এবং আর্জেন্তিনা ও মেক্সিকোতে নতুন কিছু রৌপ্যখনি আবিষ্কৃত হওয়ার পরে রৌপ্যের চাহিদা ও গুণমান কমতে থাকে, ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রৌপ্য বিনিময় প্রথা চালিয়ে যাওয়া ইংরেজ শাসকদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ায় তাই পরবর্তী পর্যায়ে, ১৮৯৩ সালে হারশেল কমিটি ও ১৮৯৮ সালে হিলটন ইয়ং কমিশন (Hilton Young Commission) এর সুপারিশ অনুযায়ী রৌপ্যমুদ্রাকে সঞ্চয় করে স্বর্ণমুদ্রাকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে একই সাথে সঞ্চয়কৃত রৌপ্যমুদ্রা, বিনিময় মাধ্যম হিসাবে স্বর্ণমুদ্রা এবং নােটমুদ্রা (paper currency)-র মাধ্যমে ভারতীয় মুদ্রা ব্যবস্থাকে ইংরেজ সরকার পরিচালনা করতে থাকে। যেটিকে অর্থনীতিবিদরা একটি বুদ্ধিমান চাল’ বলে অভিহিত করে থাকেন।
মূল্যায়ন :
উপরিউক্ত সকল দৃষ্টান্তের দিকে আমরা চোখ রাখলে বুঝতেই পারি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারতীয় অর্থনীতি ও সমাজ জীবনে ব্রিটিশ নীতির ইতিবাচক প্রভাব থাকলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ভারতীয় অর্থনৈতিক অবস্থার শােষণ-ই ঘটেছে। দাদাভাই নওরােজী (যিনি হাউস অফ কমনসের প্রথম ভারতীয় সদস্য ছিলেন), ১৮৭০ সালে ব্রিটিশদের এই শােষনমূলক নীতির প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করেন ‘ড্রেন তত্ত্ব ' (Drain Theory) এর মাধ্যমে। তার সমীক্ষানুযায়ী, অসম আমদানী ও রপ্তানির মাধমে ব্রিটিশ প্রশাসন বছরে সর্বনিম্ন প্রায় ২৪ লক্ষ কোটি টাকা এবং সর্বোচ্চ প্রায় ৫২ কোটি টাকার আত্মসাৎ ঘটিয়ে ইংল্যান্ডে প্রেরণ করত। পরবর্তীকালে আর অনেক ভারতীয় অর্থনীতিবিদ এই ডেনতত্তের পেছনে ব্রিটিশ হােমচার্জ, রেল ব্যবস্থার গ্যারান্টি বাবদ সুদ প্রদান, দেশীয় ঋণের সুদ প্রদান, বিদেশী বাঙিকং ও বীমা প্রভৃতি বিষয়কেও কারণ হিসাবে দেখিয়েছেন।
এছাড়াও ব্রিটিশ উন্নয়নমূলক নীতি বিশ্ববাণিজ্যে ভারতীয় উৎপন্ন দ্রব্যের বাজার তৈরি করে দিলেও
(commercialisation) কখনােই ভারতীয় (দেশীয়) কর্মসংস্থান বাড়াতে পারেনি বলেই অভিমত পােষণ করা হয়।
সকল দ্বিমত এবং ত্রূটি কে সামনে রেখেই বলতে পারি সবক্ষেত্রে অবশ্যই ব্রিটিশ নীতি উন্নয়নের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়নি। দেশীয় বৃদ্ধি (Domestic growth), নির্দিষ্ট মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন, রেলব্যবস্থা, শিল্পোন্নয়ন প্রভৃতির মাধ্যমে ভারতীয় আভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে যথেষ্টভাবেই চাঙ্গা করেছে, যার সুফল বর্তমান ব্যবস্থায় আমরা কিছুটা হলেও লাভ করছি।